চট্টগ্রামে বাবাকে গলা টিপে হত্যার পর লাশ ৮ টুকরা করার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন নিহত মো. হাসানের বড় ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান। বুধবার চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম সাদ্দাম হোসেনের আদালতে জবানবন্দি দেন তিনি।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. ইলিয়াস খান। তিনি বলেন, দুই আসামিকে রিমান্ডে নেয়ার পর নিহতের ছেলে মোস্তাফিজুর আজ তার বাবাকে হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে বিস্তারিত জবানবন্দি দিয়েছেন।
জবানবন্দিতে মোস্তাফিজুর বলেন, ঘটনার সপ্তাহখানেক আগে ছেনোয়ারা চট্টগ্রাম নগরীর ইপিজেড থানার আকমল আলী সড়কের পকেট গেট এলাকার জমির ভিলায় ছোট ছেলের বাসায় আসেন। হাসান ছেনোয়ারা ও ছেলে সফিকুরকে ফোন করে বসতবাড়ি বিক্রি করে দেবে বলে জানিয়ে একপর্যায়ে বলে, তোরা আমার সন্তান না। এরপর ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে সাড়ে ১১টার দিকে হাসান সফিকুরের আসায় আসেন। বাসায় ছেনোয়ারাও ছিলেন। মোস্তাফিজুর রাত ৮টার দিকে আসেন। সেদিন ভাত খেয়ে সবাই যে যার যার মতো ঘুমিয়ে পড়েন।
পরদিন (২০ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টার দিকে বাবা এবং আমরা দুই ভাই আলোচনার জন্য এক রুমে বসি। একপর্যায়ে বাবা আবার বলে- তোরা আমার সন্তান না। তখন আমাদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। বাবা আমাকে থাপ্পড় মারে। তখন আমার মাথা গরম হয়ে যায়। সহ্য করতে না পেরে বাবার গলা টিপে ধরি। এতেই বাবা মারা যায়।
লাশ গুমের তথ্য দিয়ে জবানবন্দিতে মোস্তাফিজুর জানান, হাসান মারা গেছে বুঝতে পেরে খাটের নিচে থাকা মুড়ির প্লাস্টিকের বস্তা বের করে সেটার মধ্যে ঢুকিয়ে রুমের এক কোণায় রেখে দরজায় তালা দিয়ে দুই ভাই বেরিয়ে যান। বিকেল তিনটার দিকে ছোট-বোনের জামাইকে ডেকে এনে তার সঙ্গে ছেনোয়ারাকে বাঁশখালীতে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সন্ধ্যা ৬টার দিকে রুমের দরজা খুলে সফিকুর বাবার লাশভর্তি বস্তা নিজের রুমে নিয়ে যান। তখন সফিকুরের স্ত্রী আনারকলি বিষয়টা জানতে পারেন এবং এ নিয়ে দুই ভাইকে দোষারোপ করতে থাকেন।
দুই ভাই মিলে সিদ্ধান্ত নেই লাশ টুকুরো টুকরো করে দূরে নিয়ে ফেলে দেব। ছোট ভাই পলিথিন ও কসটেপ কিনে আনার পর ঘরে থাকা ধামা (ধারালো বস্তু) দিয়ে হাত-পা কেটে আট টুকরো করে পলিথিনে মুড়িয়ে কসটেপ পেঁচিয়ে প্লাস্টিকের চালের বস্তায় ঢুকাই। শরীর আরেক বস্তায় ঢুকাই। মাথা একটি শপিংব্যাগে ভরে রুমের এক কোণায় রেখে দেই। রাত তিনটার সময় আমার ছোট ভাই একজন মদ্যপ লোককে বাইরে থেকে ডেকে এনে তাকে দিয়ে শরীরের অংশটি খালে ফেলে দেয়।
তিনি বলেন, হাত-পায়ের টুকরোগুলো ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর স্যুটকেসে ভরে রাখি। পরদিন (২১ সেপ্টেম্বর) সকালে আনারকলি ও আমি মিলে প্রথমে রিকশায় এবং পরে ক্রসিং মোড় থেকে অটোরিকশায় করে পতেঙ্গা ১২ নম্বর ঘাটে গিয়ে রাস্তার পাশে ফেলে দিই। ছোট ভাই মাথা ফেলার দায়িত্ব নিয়েছিল। আমি বাড়ি ফিরে যাই। তখন মা জিজ্ঞেস করে- তোর বাবা কই? আমি বলি- মেরে ফেলেছি। মা কপালে হাত দিয়ে কান্না করতে থাকে। ছোট ভাইকে বাড়ি যেতে বললেও সে মোবাইল বন্ধ করে রাখায় যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। পরদিন (২২ সেপ্টেম্বর) মাগরিবের নামাজের পর ইউপি মেম্বার পুলিশ নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসে। পুলিশ আমাকে বাবা কোথায় জিজ্ঞাসা করে। আমি বলি- জাহাজে। যোগাযোগ আছে কি না জানতে চায়। পরদিন আমার নানার বাড়ি থেকে আমাকে ও মাকে পুলিশ নিয়ে আসে।
এ ঘটনায় পতেঙ্গা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আব্দুল কাদির বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ছায়া তদন্ত চালিয়ে নিশ্চিত হয়, নিহত ওই ব্যক্তি চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার কাতারিয়া ইউনিয়নের গ্রামের বাসিন্দা মো. হাসান। এ ঘটনায় তার স্ত্রী ও ছেলে মোস্তাফিজুরকে আটকের পর আদালতের মাধ্যমে তাদের ২৪ সেপ্টেম্বর পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয় পিবিআই। পাশাপাশি মামলাটিও পিবিআই তদন্তের দায়িত্ব পায়। অভিযুক্ত ছোট ছেলে ও তার স্ত্রী এখনো পলাতক।
তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম মহানগর ইউনিটের পরিদর্শক মো. ইলিয়াস খাঁন বলেন, হত্যা মামলা তদন্তে নেমেই আমরা নিহত ব্যক্তির স্ত্রী ও ছেলে মোস্তাফিজুরকে গ্রেফতার করেছিলাম। আদালতের নির্দেশে তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করি। বুধবার মোস্তাফিজুরকে আদালতে হাজির করা হলে তিনি স্বেচ্ছায় খুনের দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। এরপর আদালতের নির্দেশে তারা কারাগারে পাঠানো হয়েছে।