শেষ ভালো যার, আসলেই কি শেষ ভালো তার? শেষটা ভালো হওয়ার একটা স্বস্তি থাকতে পারে, কিন্তু তার মানে যে আগের সবকিছুকে হঠাৎ ভালো মনে হবে এমন তো কোনো কথা নেই।
বাংলাদেশের ফুটবলের ২০২৪ সালটাই দেখুন না! মালদ্বীপের বিপক্ষে তিনদিন আগে ২-১ গোলের জয়টার পর কী একটা স্বস্তির বাতাস বয়ে গেল! স্বস্তি এই যে, যাক, বছরটা অন্তত জয়ে শেষ করা গেছে! শেষ ম্যাচ দুটা গোল পাওয়া গেছে!
কারণ, এর আগে পুরো বছরে বাংলাদেশ ম্যাচ জিতেছিল মাত্র একটি। মালদ্বীপের বিপক্ষে শেষ ম্যাচে দুই গোলের আগে পুরো বছরে ৮ ম্যাচে বাংলাদেশের গোল বলতে শুধু ভুটানের বিপক্ষে আগের জয়ের পথে পাওয়া একমাত্র গোলটিই ছিল। কিন্তু এই এক জয়ের শেষটা সুন্দর হলেও পুরো বছরের যাত্রাপথটা তো সুন্দর হয়ে যায়নি!
কিন্তু গতকাল যখন ভারতের ফুটবল দল বছরে তাদের শেষ ম্যাচটি খেলল, তাদের পুরো বছরের পথচলার দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, ‘কে বেশি খারাপ খেলেছে পুরো বছরে’ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের চেয়েও পিছিয়ে পড়েছে ভারত!
গোল তারাও সেভাবে পায়নি, বাংলাদেশের চেয়ে বছরে এক গোল বেশি করেছে ৩টি ম্যাচ বেশি খেলে। গোল খাওয়ায় বাংলাদেশের সমানে সমান। তবে বাংলাদেশের তুলনায় ভারতের পরিসংখ্যানটাকে আরও বেশি শূন্যতায় ভরিয়ে দিচ্ছে জয়ের ঘরের সংখ্যাটা – পুরো বছরে বাংলাদেশ তবু ২টি জয় পেয়েছে, ভারত যে বছরটা শেষ করল কোনো জয় না পেয়েই!
মালয়েশিয়ার বিপক্ষে গতকাল গোলকিপারের ভুলে পিছিয়ে পড়েও শেষ পর্যন্ত ১-১ ড্র নিয়ে মাঠ ছেড়েছে ভারত। এরপর তাদের ২০২৪ সালের পরিসংখ্যানটা দাঁড়িয়েছে এই যে, ১১ ম্যাচে ৬ হার, ৫ ড্র। গোল করেছে ৪টি, খেয়েছে ১৫টি। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান তো আপনার জানাই – ২০২৪ সালে ৮ ম্যাচে ২ জয়ের বিপরীতে ৬ হার, গোল করেছে ৩টি, খেয়েছে ১৫টি।
অবশ্য প্রতিপক্ষের মান বিবেচনায় ভারতের ম্যাচগুলোকেই বেশি কঠিন মনে হতে পারে। আলী আশফাকদের প্রজন্মের বিদায়ের পর মালদ্বীপকে গত দুই বছরে আবার নিয়মিত হারাতে শুরু করেছে বাংলাদেশ, ভুটানকে তো হারায়ই। তবু দুই দলের বিপক্ষে সর্বশেষ প্রীতি ম্যাচগুলোতে বাংলাদেশের রেকর্ড – দুই দলের বিপক্ষেই ১টি করে জয়, ১টি করে হার। এর বাইরে বাংলাদেশ এ বছরে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে অস্ট্রেলিয়া আর লেবাননের বিপক্ষে একটি করে, আর ফিলিস্তিনের বিপক্ষে দুটি ম্যাচ খেলেছে।
অন্যদিকে ভারত? বছর শুরু করেছে এশিয়ান কাপে অস্ট্রেলিয়া, উজবেকিস্তান আর সিরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। এরপর বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে খেলেছে কুয়েতের বিপক্ষে একটি আর আফগানিস্তানের বিপক্ষে দুটি ম্যাচ। মরিশাস আর সিরিয়ার বিপক্ষে ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের নামের প্রীতি ম্যাচের আড়ালে পোশাকি টুর্নামেন্টের পর বছর শেষ করেছে ভিয়েতনাম আর মালয়েশিয়ার বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ দিয়ে।
ভারতের দল অবশ্য এ বছরে বড় দুটি বদল দেখেছে। এশিয়ান কাপে তিন ম্যাচেই হেরে গ্রুপ পর্বে বিদায়ের পর ক্রোয়েশিয়ান ইগর স্তিমাচকে বাদ দিয়ে স্প্যানিশ মানোলো মার্কেসকে নিয়োগ দিয়েছে ভারত। তাঁর অধীনে ধীরে ধীরে গুছিয়ে নেওয়া ভারত আগামী বছরকে ঘিরে নতুন স্বপ্নও বুনছে। তবে এর চেয়েও বড় ধাক্কাটা ভারত সম্ভবত খেয়েছে গত জুনে, যখন বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে কুয়েতের বিপক্ষে গোলশূন্য ড্র ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শেষ টেনে দেন ভারতের কিংবদন্তি স্ট্রাইকার সুনীল ছেত্রী।
পালাবদল, জয় না পাওয়া – সব মিলিয়ে ভারতের এই বছরটা এমনই কেটেছে যে, ২০২৩ সালের সুখস্মৃতিকে এখন হয়তো ভারতের ফুটবলপ্রেমীদের কাছে দূর অতীত মনে হচ্ছে। অথচ গত বছরে ১৬ ম্যাচে ১০ জয়ের বিপরীতে ভারত হেরেছিল ৪ ম্যাচে। গোল করেছিল ২১টি, খেয়েছে ১২টি। সাফের শিরোপা জেতার পথে কুয়েত, লেবাননকে টাইব্রেকারে হারানো ভারত তখন মায়ানমার, কিরগিজস্তানকে প্রীতি ম্যাচে হারানোর পাশাপাশি বিশ্বকাপ বাছাইপর্বেও কুয়েতকে হারিয়েছিল!
২০২৩ সাল অবশ্য বাংলাদেশেরও বেশ ভালো কেটেছিল। ১৪ ম্যাচে ৫ জয় আর ৫ ড্রয়ের বিপরীতে হার ছিল ৪টি। ১৮ গোল খেলেও বাংলাদেশ সে বছরে গোল করেছিল ১৪টি। ওই চার হারের মধ্যেও সাফে লেবানন আর কুয়েতের কাছে দারুণ লড়ে হার, বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে অন্তত ৪-৫টি দারুণ সুযোগ হারিয়ে লেবাননের সঙ্গে ঘরের মাঠে ড্র বাংলাদেশের আফসোস বাড়িয়েছিল।
হাভিয়ের কাবরেরার অধীনে সে সময়ে বাংলাদেশের ফুটবলও প্রাণ ছুঁয়েছে। স্ট্রাইকারহীন বাংলাদেশকে দুই ইনসাইড ফরোয়ার্ড রেখে ৪-১-২-১-২ ছকে দারুণ পাসিং, প্রেসিং ফুটবল খেলিয়েছেন স্প্যানিশ কোচ। কিন্তু এ বছরে বাংলাদেশের ফরোয়ার্ড লাইনে তিন নিয়মিত মুখের মধ্যে রাকিব হোসেন আর ফয়সাল আহমেদ ফাহিম কোনো গোল বা অ্যাসিস্টই পাননি।
মোরসালিন গত বছরে আশা জাগিয়ে শুরু করেও এরপর মদ-কান্ডে নিষেধাজ্ঞায় পড়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফিরেছেন দ্রুতই। তবে এ বছরে তাঁর কাছ থেকেও খুব ভালো কিছু পায়নি বাংলাদেশ। চোটের কারণে ফিলিস্তিনের বিপক্ষে দুই ম্যাচে খেলতে না পারা মোরসালিন পুরো বছরে শুধু ভুটানের বিপক্ষে একটা গোল করেছেন, আর মালদ্বীপের বিপক্ষে সর্বশেষ ম্যাচে একটা গোল করিয়েছেন।
বছরজুড়ে হামজা চৌধুরীকে পাওয়া-না পাওয়ার দোলাচলে কেটেছে বাংলাদেশের। তাঁকে আগামী বছর বাংলাদেশের জার্সিতে হয়তো দেখা যাবে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত আরও অনেক বিদেশিকে জাতীয় দলে দেখার দাবি সমর্থকদের মধ্যে থাকলেও বাফুফের দিক থেকে এখনো তেমন নড়াচড়া চোখে পড়েনি।
আর কাবরেরার ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কা তো আছেই! তিন বছরে বাংলাদেশের খেলার স্টাইলে বেশ উন্নতি এনেছেন স্প্যানিশ কোচ, তবে গত বছরে দলের পারফরম্যান্সের কারণে তাঁর সঙ্গে আগামী ডিসেম্বরে শেষ হতে যাওয়া চুক্তিটা বাফুফে আর নবায়ন করবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা আছে। কাবরেরা চালিয়ে গেলে, পাশাপাশি হামজাও দ্রুত যোগ দিলে ২০২৫ সাল নিয়ে বাংলাদেশও হয়তো আরও আশাবাদী হতে পারবে।
তখন ভারতের সঙ্গে না হয় ‘বছরে কে বেশি ভালো খেলেছে’ প্রতিযোগিতাটাই হোক!