ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা বরগুনাগামী অভিযান-১০ লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের এক বছর পূর্ণ হয়েছে শনিবার (২৪ ডিসেম্বর)। ২০২১ সালের এই দিনে এ অগ্নিকাণ্ড হয়। ঘটনার পরপরই হতাহতদের উদ্ধারে এগিয়ে আসে স্থানীয়রা। পরে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় বরিশাল নৌ পুলিশ, নৌ ফায়ার সার্ভিস, স্থানীয় ফায়ার সাভিস, জেলা পুলিশ ও জেলা প্রশাসন। তবে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার আগেই সম্পূর্ণ পুড়ে যায় লঞ্চটি।
এ ঘটনায় উদ্ধার করা হয় ৪৭টি মরদেহ, অগ্নিদগ্ধ হয় আড়াইশ’রও বেশি মানুষ। ঘটনার এক বছর পেরিয়ে গেলেও মেলেনি ডিএনএ রিপোর্ট। পরিচয় সনাক্ত হয়নি পুড়ে যাওয়া ১৬টি মরদেহের। এদিকে, এ ঘটনার পরেই ঝালকাঠিতে একটি নৌ ফায়ার ষ্টেশনের দাবি উঠলেও তাও পূরণ হয়নি। তবে নৌ ফায়ার স্টেশন স্থাপনের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়েছে জানিয়েছে ঝালকাঠি ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।
পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী এবং উদ্ধারকর্মীরা জনায়, গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে ঢাকার সদরঘাট থেকে বরগুনার উদ্দেশ্যে ৬ শতাধিক যাত্রী নিয়ে রওনা হয় অভিযান-১০ লঞ্চ। গন্তব্যে পৌছার আগেই ঝালকাঠির সুগন্ধার মোহনায় এলে ইঞ্জিন বিস্ফোরিত লঞ্চে আগুন ধরে যায়। ২ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে নদীর মধ্যে জ্বলতে থাকে পুরো লঞ্চ। পরে ভাসতে ভাসতে দিয়াকুল এলাকার চরে আটকে যায়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা সেখানে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে কিন্তু ততক্ষণে ভষ্মিভুত হয়ে যায় পুরো লঞ্চটি। জীবন বাচাঁতে নদীতে ঝাপিয়ে পড়েন অসংখ্য যাত্রী। বের হতে না পেরে অনেকে লঞ্চের ভেতরেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। এদিন আগুনে পোড়া ৩৭টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে নদী থেকে ৪ জন এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ৬ জনের মৃত্যু হয়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, অভিযান লঞ্চে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা যদি দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারত তাহলে এতো প্রাণহানির ঘটনা ঘটত না। তবে অগ্নিদগ্ধদের উদ্ধার এবং তাদের আশ্রয় ও সেবা দিয়ে মানবতার দৃষ্টান্ত রাখেন ঝালকাঠি শহরের লোকজন। বিশেষ করে দিয়াকুলের সাধারণ গ্রামবাসী। লঞ্চ থেকে নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে অনেকে প্রাণ বাঁচান। সেদিনের সেই ভেঁজা কাপড় আজও দিয়াকুল গ্রামে ভয়াল স্মৃতি হয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছে। আর সেই রাতের কথা স্মরণ করে আজও শিউরে ওঠেন তারা।
এ ঘটনায় পুরাতন ঢাকার মনির হোসেন নামে এক ব্যক্তি বাদি হয়ে ঝালকাঠি থানায় ৪ মালিকসহ ৮ জনের নামে মামলা করেন। পরবর্তী সময়ে মামলাটি নৌ আদালতে হস্তান্তর করা হয় এবং পোড়া লঞ্চটি আদালত মালিক পক্ষের জিম্মায় দেন। বর্তমানে মামলাটি নৌ আদালতে চলমান রয়েছে এবং বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে। পুড়ে মারা যাওয়া ১৬ ব্যক্তির ডিএনএ রিপোর্ট এখনও যাওয়া যায়নি। ওই রিপোর্ট পেলে তাদের পরিচয় শনাক্ত হওয়া যাবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
অভিযান ১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সাতচল্লিশ জন মারা যাওয়ার ৪১ দিন আগেও সুগন্ধা নদীতে সাগর নন্দিনী নামে একটি তেলের জাহাজে অগ্নিকাণ্ডে ৭ জনের মৃত্যু হয়। সুগন্ধা নদীতে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রাণহানি ঘটলেও নৌ ফায়ার স্টেশন স্থাপন হয়নি। দ্রুত নৌ ফায়ার ষ্টেশন স্থাপনের দাবি জেলাবাসীর।
দিয়াকুল গ্রামের রিনা বেগম বলেন, সেই দিনের ভয়াল ঘটনা এখনো চোখের সামনে ভাসে। কত মানুষকে আমরা নদী থেকে উদ্ধার করে বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলাম। তাদের কাপড় দিয়েছি, খাবারও। সে কথা এখনও মনে পড়লে চোখে পানি এসে যায়।
ঝালকাঠির ফারহান-৭ লঞ্চের ঘাট সুপারভাইজার মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, ঝালকাঠি থেকে যাত্রীবাহী লঞ্চ ও পণ্যবাহী অসংখ্য জাহাজ চলাচল করে। এখানে গাবখান চ্যানেল রয়েছে। এই চ্যানেল দিয়ে খুলনা, মোংলা ও কলকাতা যায় অনেক নৌযান। এ ছাড়াও বরগুনা, পাথরঘাটা, বরিশাল ও ঢাকায় পণ্যবাহী ও যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল করে। গুরুত্বপূর্ণ এই পয়েন্টে একটি নৌ ফায়ার স্টেশন জরুরি হয়ে পড়েছে।
ঝালকাঠি ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার শফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে নৌ ফায়ার স্টেশনের জন্য আবেদন করেছি। কিন্তু এক বছর পার হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা রয়েছে, যাতে ঝালকাঠিতে একটি নৌ ফায়ার স্টেশন হয়। এতে ডুবুরি দলও থাকবে, দুর্ঘটনা হলে দ্রুত ঘঁনাস্থলে পৌঁছানো যাবে।
ঝালকাঠি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নজরুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনায় দায়ের হওয়া একটি মামলা ঢাকার নৌ আদালতে চলমান রয়েছে। আমি প্রাথমিকভাবে মামলাটি তদন্ত করেছি, আলামতও জব্দ করেছি। আদালতের নির্দেশে পোড়া লঞ্চটি মালিক পক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এক বছর হলেও আমরা এখনও ১৬ জনের ডিএনএ রিপোর্ট পাইনি।