Facebook
Twitter
WhatsApp

২৯ বছর জঙ্গলে কাটালেন আত্মসমপর্ণ করতে না চাওয়া এই যোদ্ধা

image_pdfimage_print

ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ পালনে প্রায় তিন দশক কাটিয়ে দিয়েছিলেন ভিন্‌দেশের জঙ্গলে। এমনকি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বহু বছর পরেও বিশ্বাস করেননি, যুদ্ধ শেষ! সেনাকর্তার আদেশ মেনে ওই জঙ্গলেই থেকে গিয়েছিলেন জাপানের সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা আধিকারিক হিরু ওনোদা। সেখানেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন জীবনের ২৯টি বছর।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বহু বছর পর হিরুর কাহিনী জানতে পারে তার দেশ। ১৯৫৯ সালে তাকে সরকারি ভাবে ‘মৃত’ বলে ঘোষণা করেছিল তৎকালীন জাপান সরকার। তবে তার সন্ধান চালিয়ে যান সে দেশের এক ছাত্র, নোরিয়ো সুজুকি। ১৯৭৪ সালে তিনিই খুঁজে পান হিরুকে। ফিলিপিন্সের জঙ্গল থেকে দেশে ফেরার জন্য আবেদন-নিবেদন করলেও সুজুকির কথায় কর্ণপাত করেননি হিরু। এমনকি, সেই ১৯৭৪ সালেও তার বিশ্বাস হয়নি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ। তখনও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশের অপেক্ষায় ঠায় বসেছিলেন হিরু।

১৯৪২ সালে জাপানের সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছিলেন হিরু। বছর দুই পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝে তাকে ফিলিপিন্সে পাঠানো হয়েছিল। সেকেন্ড লেফ্টেন্যান্ট পদমর্যাদার হিরুকে আদেশ দেওয়া হয়েছিল, ঐ জঙ্গলে ঘাঁটি আঁকড়ে পড়ে থাকতে। বলা হয়েছিল- ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের শেষ নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে। তাই করেছিলেন হিরু। ১৯৪৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ফিলিপিন্সের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে লুবাং দ্বীপের জঙ্গলে ঘাঁটি গাড়েছিলেন হিরু। ম্যানিলা থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরের ঐ দ্বীপে গোড়ায় তার সঙ্গে আরো তিন জন জাপানি সেনাকে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন। একে একে তারা মারা যান। কর্তব্যপালনে একাই জঙ্গলে থেকে যান হিরু।

রোগাপাতলা চেহারার ২২ বছরের হিরুর সঙ্গী বলতে ছিল একটি রাইফেল এবং তরোয়াল। গেরিলা যুদ্ধে সিদ্ধহস্ত হিরু সেনার উর্দিতে সেই তরোয়ালে নিয়মিত শান দিতেন। শত্রুকে খতম করতে রাইফেলটিকেও বাগিয়ে রাখতেন। প্রায় তিন দশক ধরে জঙ্গলে থাকাকালীন হিরুর খাদ্য ছিল দ্বীপের বাসিন্দাদের থেকে চুরি করা চাল, নারিকেল আর কলা। স্থানীয়দের গৃহপালিত পশুদের মেরে মাংসও রেঁধে খেতেন। জঙ্গলে থাকার জন্য একটি বাঁশের ঘর তৈরি করেছিলেন হিরুরা।

ইতিহাস বলে, ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছিল। সে বছরের আগস্টে জাপানের পরাজয়ের পর প্রচারপুস্তিকায় যুদ্ধশেষের খবর ছড়ানো হয়েছিল ফিলিপিন্সের ঐ দ্বীপে। সে খবরে বিশ্বাস করেননি হিরু এবং তার তিন সঙ্গী। মনে করেছিলেন, এ সবই শত্রুপক্ষের প্রচারকৌশল। যুদ্ধশেষে আমেরিকা এবং ফিলিপিন্সের তল্লাশি দলের সদস্য থেকে দ্বীপের বাসিন্দা- সবাকেই আক্রমণও করতেন তিনি। জঙ্গলে থাকাকালীন জনা তিরিশেক স্থানীয় বাসিন্দাকে হত্যা করেছিলেন হিরু। তার ধারণা ছিল, ঐ বাসিন্দারা আসলে শত্রুপক্ষের সেনা।

১৯৫০ সালে ফিলিপিনো সেনার হাতে আত্মসমর্পণ করেন হিরুর সঙ্গী। অভিযোগ, রাজনৈতিক গোষ্ঠীত্যাগী ভেবে বাকি দুই জনকে যথাক্রমে ১৯৫৪ এবং ১৯৭২ সালে গুলো করে মারে ফিলিপিনো পুলিশ। পঞ্চাশের দশকের শেষ ভাগে সরকারি ভাবে হিরুর মৃত্যুর খবর চাউর হয়ে গেলেও তা মানতে নারাজ ছিলেন জনৈক জাপানি পড়ুয়া সুজুকি। হিরুর খোঁজে তিনি ফিলিপিন্সের ঐ দ্বীপে পৌঁছে যান। শেষমেশ তাকে খুঁজে বারও করেন। এরপর শুরু হয় হিরুকে দেশে ফেরানোর প্রচেষ্টা।

তবে সুজুকির কথায় চিঁড়ে ভেজেনি। তার মনে ছিল ১৯৪৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির কথা। আমেরিকার সেনাবাহিনীর দাপটে জাপান কোণঠাসা হয়ে পড়লে হিরুকে একটি নির্দেশ দিয়েছিলেন তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মেজর ইয়োশিমি তানিগুচি। হিরুকে ফিলিপিন্সে পাঠানোর সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন,‘তিন বছর লাগতে পারে, পাঁচ বছরও লাগতে পারে। তবে যাই ঘটুক না কেন, আমরা তোমাকে দেশে নিয়ে যেতে আসব।’ হিরুকে দেশে ফেরাতে ব্যর্থ হয়ে জাপানে ফিরে গিয়েছিলেন সুজুকি। সঙ্গে ছিল হিরুর বহু ছবি। সে সব প্রমাণ দেখে হিরুকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ঐ দ্বীপে প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিল জাপান সরকার। সে দলে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর তানিগুচিও।

২৯ বছর পর হিরুর মুখোমুখি হয়েছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর। সেনা থেকে অবসরের পর পেশায় তিনি তখন বইবিক্রেতা। লুবাং দ্বীপে পৌঁছে নিজের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর। প্রায় তিন দশক পরেও ঊর্ধ্বতনের প্রতি আনুগত্যের অভাব ছিল না হিরুর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের খবর দিয়ে হিরুকে তার কর্তব্য থেকে মুক্ত করেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর। অবসরপ্রাপ্ত মেজরকে দেখামাত্র কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন হিরু। তবে ছেঁড়াফাটা উর্দিতে ঊর্ধ্বতনকে সেলাম ঠুকতে ভোলেননি।

১৯৭৪-এর মার্চে জাপানে ফেরার পর রাজকীয় সম্মান জুটেছিল হিরুর। শোভাযাত্রা করে স্বাগত জানানোর পর তাঁকে বীরের সংবর্ধনার দিয়েছিল দেশবাসী। যাবতীয় অনুষ্ঠান শেষে তার স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা হয়েছিল। চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, এত বছর ধরে জঙ্গলে কাটানোর পরেও আশ্চর্যজনক ভাবে সুস্থ রয়েছেন হিরু। কর্তব্যনিষ্ঠার যে প্রমাণ দিয়েছিলেন হিরু, তাতে রাতারাতি জাতীয় নায়ক হয়ে যান তিনি। তার কাহিনী শুনতে উদ্‌গ্রীব ছিল আমজনতা। ১৯৭৪ সালে দেশে ফেরার পর সে কাহিনী নিজের লেখনীতে জানানোর জন্য বরাতও পেয়ে যান হিরু। সেনার তরফে পেনশনের পাশাপাশি স্মৃতিকথা লেখার জন্য এক লাখ ৬০ হাজার ডলারের চুক্তি হাতে পেয়ে যান তিনি।

সে বছরেই ‘নো সারেন্ডার: মাই থার্টি-ইয়ার ওয়ার’ নামে এক স্মৃতিকথা লিখে ফেলেন হিরু। যে গল্প ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো দুনিয়ায়। প্রতিবেদন, বইয়ের পাতা থেকে তথ্যচিত্রে জায়গা করে নেয় হিরুর কাহিনী। যদিও ঝাঁ-চকচকে জাপানের জীবনযাত্রার সঙ্গে বেশি দিন খাপ খাওয়াতে পারেননি হিরু। নিজের দেশ ছেড়ে ১৯৭৫-এ ব্রাজিল চলে যান তিনি। সে দেশে কৃষিকাজ করতেন। তবে ১৯৮৪ সালে আবার জাপানে ফিরে যান। এরপর জাপান জুড়ে ‘ন্যাচার ক্যাম্প’ খুলেছিলেন তিনি।

আরো একটি সুখবর এসেছিল হিরুর জীবনে। ফিলিপিন্সে থাকাকালীন যে ৩০ জনকে হত্যায় দায়ী ছিলেন হিরু, সে অপরাধ মাফ করে দিয়েছিলেন সে দেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস। প্রেসিডেন্টের কাছে প্রথাগত ভাবে আত্মসমর্পণ করার সময় হিরুর পরনে ছিল সেই ৩০ বছরের পুরনো উর্দি, টুপি এবং তরোয়াল। সবেরই বেশ যত্ন নিয়েছিলেন হিরু। ২০২১ সালে সিনেমার পর্দায় জায়গা করে নিয়েছিলেন হিরু। ‘ওনোদা: ১০ হাজার নাইটস ইন দ্য জাঙ্গল’ নামে একটি ফরাসি ছবিতে দেখা গিয়েছিল হিরুর কাহিনী।

বাস্তব এবং পর্দা, দুয়েতেই নায়কের ভূমিকা নিলেও সেনার শিক্ষা আজীবন মনে রেখেছিলেন হিরু। তিনি বলেন, ‘আমি সৌভাগ্যবান যে কম বয়সে কর্তব্যপালনে নিজেকে নিয়োজিত করতে পেরেছি।’ প্রায় তিন দশক ধরে জঙ্গলে থাকাকালীন কী চিন্তাভাবনা চলত তার মনে? হিরুর নির্লিপ্ত জবাব, ‘কিছুই না। শুধুমাত্র নিজের কর্তব্য পালন করার কথাই ভাবতাম।

খবরটি শেয়ার করুন

Table of Contents

প্রধান উপদেষ্ঠা : আলহাজ্ব ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ এমপি, সংসদ-সদস্য ঢাকা ১৬,প্রকাশক : মোঃ মাসুদ রানা (জিয়া) ।সম্পাদক : শাহাজাদা শামস ইবনে শফিক।সহকারী সম্পাদক : সৌরভ হাসান সোহাগ খাঁন। 

Subscribe Now

নিউজরুম চিফ এডিটর : মোঃ শরিফুল ইসলাম রবিন।সম্পাদকীয় কার্যালয় : ১২০/এ মতিঝিল বা/এ, ৪থ তলা, সুইট-৪০২, ঢাকা- ১০০০বার্তা কক্ষ : ০১৬৪২০৭৮১৬৪ – বিজ্ঞাপনের জন্য : ০১৬৮৬৫৭১৩৩৭

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by www.channelmuskan.tv © 2022

x