চক্র একই। কৌশলও একই। মূল ভূমিকা পালন করেন কথিত প্রেমিকা। চক্রের অন্য সদস্যরা মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে দেন। আর সেই নম্বরে কখনও মিস কলড বা সরাসরি কল। আবার কখনও মেসেজ দিয়ে ঘটনার শুরু হয়। মিষ্টি কণ্ঠের অধিকারী বিলকিস খুব দ্রুতই মোবাইল নম্বরের মালিকদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন।

অন্তরঙ্গ কথা বলে দুর্বল করেন ওই ব্যক্তিদের। শুরু প্রেমের সম্পর্ক। তারপর আপত্তিকর কথা বলা। অডিও-ভিডিও কলে আদান-প্রদান করা হয় খোলামেলা ছবি ও ভিডিও।

অল্পদিনের ভেতরে বিলকিস শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব দেন। রাজি হলেই নির্ধারিত স্থানের কথা জানান। প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া প্রেমিকরা তখনও জানেন না তাদের ভাগ্যে কি অপেক্ষা করছে। যদি বিলকিস তাদেরকে বাসায় নিয়ে যান তবে সেখানে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের পরিবেশ সৃষ্টি করেন। মিলিত হন অন্তরঙ্গ মুহূর্তে। তারপর সেখানে হাজির হন চক্রের অন্য পুরুষ সদস্য। তিনি সেখানে হাজির হয়ে পুলিশ, ডিবি, সাংবাদিক বা এলাকার বড় ভাই পরিচয় দিয়ে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের নগ্ন ভিডিও করা শুরু করেন। সঙ্গে কিছু স্থির ছবি তোলেন। আর এসব ছবি ও ভিডিও দিয়ে শুরু হয় ব্ল্যাকমেইল করে টাকা আদায়। আর কেউ যদি বাসায় যেতে রাজি না হয় তবে তার সঙ্গে বাসার বাইরে দেখা করে অপহরণ করে নিয়ে আসেন বাসায়। বাসায় আসার পর কেউ যদি পরিবেশ দেখে নগ্ন হতে রাজি না হন তবে তাকে মারধর ও অমানবিক শারীরিক নির্যাতন করে নগ্ন ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করা হয়।

এভাবে দীর্ঘদিন ধরে বিলকিস ও তার চক্রের সদস্যরা শতাধিক ব্যক্তিকে ফাঁদে ফেলে কোটি কোটি টাকা আদায় করেছে। বিলকিস তার মোবাইলে সংরক্ষণ করে রেখেছে তার শতাধিক প্রেমিকের নগ্ন ভিডিও। তবে বেশিদূর যেতে পারেননি বিলকিস ও চক্রের অন্যান্য সদস্যরা। এক ভুক্তভোগীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে সাভার থানা এলাকা থেকে দারুসসালাম থানার পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় চক্রের মূলহোতাসহ দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। গ্রেপ্তারকৃতদের নাম- খোকন আকন্দ ও বিলকিস আক্তার। এ সময় তাদের হেফাজত থেকে ৩টি মোবাইল ফোন, ৩টি সিমকার্ড ১টি স্বাক্ষরকৃত চেকের পাতা (ব্যাংক এশিয়ার), ৩টি ১০০ টাকা মূল্যের নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প এবং জব্দকৃত মোবাইলে বিভিন্ন ভুক্তভোগীর সঙ্গে আপত্তিকর মুহূর্তের শতাধিক ভিডিও ও স্থিরচিত্র জব্দ করা হয়।

ডিবিসূত্র জানায়, বিলকিস, আকন্দ ও চক্রের অন্য সদস্যরা নানা কৌশলে সাধারণ মানুষদের তাদের ফাঁদে ফেলে সর্বস্ব লুটে নিত। খোকন প্রথমে সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট থেকে টার্গেট করে বিত্তশালী ব্যক্তির নম্বর সংগ্রহ করতো। এরপর বিলকিস বিভিন্ন পরিচয়ে ওই নম্বরে কল বা মেসেজ দিয়ে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করে। নিয়মিত কথা বলে টার্গেট ব্যক্তিকে তার প্রতি আসক্ত করে। দুর্বল করার জন্য অডিও-ভিডিও কলে আপত্তিকর কথা বলতো। নিজেকে খোলামেলাভাবে ভিডিও কলে উপস্থাপন করে টার্গেট ব্যক্তিদের শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব দিত। প্রস্তাবে সাড়া দিলে চক্রের অন্যান্য সদস্যদের পরিকল্পনা অনুযায়ী সুবিধাজনক স্থানে আসার প্রস্তাব দিত। সেখানে আসা মাত্র অসামাজিক কার্যকলাপ ও অন্তরঙ্গ মুহূর্তে নিয়ে যেত। অন্তরঙ্গ থাকা অবস্থায় খোকন আকন্দ পরিকল্পিত ভাবে সেখানে প্রবেশ করে কখনো ডিবি পুলিশ/সিআইডি বা সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে মোবাইল ফোনে তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও- স্থিরচিত্র ধারণ করত। কেউ অন্তরঙ্গ মুহূর্তে যেতে না চাইলে জোরপূর্বক মারধর করে বিবস্ত্র করে ভিডিও করে রাখতো। এরপর সে ভিডিওগুলো পরিবারের কাছে পাঠাবে এবং ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে আদায় করা হতো মোটা অংকের টাকা। ভুক্তভোগীর সঙ্গে এটিএম কার্ড থাকলে সেগুলোর পিন নম্বর নিয়ে অ্যাকাউন্ট ফাঁকা করে চোখ বেঁধে নির্জন স্থানে ফেলে রেখে যেত।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, সংঘবদ্ধ চক্রটি ২০১৮ সাল থেকে শতাধিক ভুক্তভোগীর কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় এই মামলার বাদীকে ব্ল্যাকমেইল চক্রের সদস্য নিজেকে বিলকিস আক্তার বলে পরিচয় দেয় এবং বাদীর কোম্পানিতে তিনিসহ তার কয়েকজন আত্মীয় ইন্স্যুরেন্স করবে বলে জানায়। পরদিন ইন্স্যুরেন্স করার জন্য বিলকিস মামলার বাদীকে দারুসসালাম এলাকায় যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। একদিন পরেই বিলকিস বাদীর অফিসের নিচে গিয়ে বাদীকে নিয়ে আসার জন্য অপেক্ষা করেন। বাদী অফিস শেষ করে উক্ত ব্যক্তির সঙ্গে সিএনজিযোগে দারুসসালাম, গাবতলী এলাকার দিকে রওনা হয়ে গাবতলী বাস্ট্যান্ড এলাকায় পৌঁছলে অজ্ঞাত আরও ২/৩ জন ব্যক্তি ওই সিএনজিতে ওঠেন। পরে বিলকিস ও অন্যদের সহায়তায় তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে কালো ওড়না জাতীয় কাপড় দিয়ে বাদীর চোখ মুখ বেঁধে ফেলে এবং মুখে সাদা রুমাল গুঁজে দেয়। এরপর তাকে জোরপূর্বক অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে একটি অন্ধকার কক্ষে নিয়ে যায়। সেখানে বাঁশের লাঠি দিয়ে বেধড়ক মারপিট করে গুরুতর জখম করে। তারপর জোরপূর্বক তাকে বিবস্ত্র করে মোবাইল ফোনে বেশকিছু নগ্ন আপত্তিকর ভিডিও/স্থিরচিত্র ধারণ করে। বাদীকে মারপিটের পাশাপাশি বাদীর কাছ থেকে নগদ ৩৫ হাজার টাকা নেয়। তার কাছে থাকা ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এটিএম কার্ডের পিন কোড জেনে সেখান থেকে তুলে নেয় এক লাখ টাকা। এছাড়াও চেক বইয়ের ১টি পাতায় চার লাখ টাকা লিখে স্বাক্ষর নেওয়ার পাশাপশি একটি ব্লাঙ্ক স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে ছেড়ে দেয়। কিছুদিন পরে অন্য আরেকটি নম্বর থেকে আগে ধারণ করা আপত্তিকর অবস্থার ভিডিও প্রকাশের ভয় দেখিয়ে ২০ লাখ টাকা দাবি করে বিভিন্ন হুমকিমূলক ভয়েস রেকর্ড পাঠায়।

ডিবি সাইবার ও স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অর্গানাইজ্ড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মো. নাজমুল হক বলেন, গত কয়েক বছরে শতাধিক মানুষকে টার্গেট করে প্রেমের ফাঁদে ফেলে শারীরিক সম্পর্কের লোভ দেখিয়ে অপহরণ করেছে তারা। তারপর জোরপূর্বক নগ্ন করে আপত্তিকর ভিডিও-ছবি ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করেছে। এছাড়া ভুক্তভোগীদের সঙ্গে থাকা সবকিছু ছিনিয়ে নিয়েছে। ধারণ করা ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েও টাকা আদায় করেছে। আমরা বিলকিসের কাছে শতাধিক ভুক্তভোগীর নগ্ন ভিডিও পেয়েছি। তাদের সঙ্গে আর কেউ জড়িত আছে কিনা তা জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।