ঢাকার অভয় দাস লেনে ভোলানন্দ গিরি আশ্রম। সেখানেই সান্ধ্য আরতি বা প্রার্থনায় বসেছেন জনা বিশেক সনাতন ধর্মের অনুসারী। প্রার্থনা শেষে কথা হয় তাদেরই একজন সুস্মিতা দেবীর সঙ্গে।
সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে, সুস্মিতা দেবী জানালেন মন্দিরে নিয়মিত আসলেও এখন একটা ভয় ঢুকে গেছে মনে।
সুস্মিতা দেবী বলছেন, এই যে হামলা হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। আমার নিজের আত্মীয়ের বাড়িতেও এবং মন্দিরে হামলা হয়েছে। তারা কোনো দলীয় লোক ছিল না।আমি নিজে সরাসরি হামলার শিকার হইনি, কিন্তু এগুলো দেখে ভয় তো লাগে।
বাংলাদেশে যখন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দুর্গাপূজার আয়োজন চলছে, তখন সুস্মিতা দেবীর মতো হিন্দুদের অনেকেই নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কথা জানাচ্ছেন।
বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলার অভিযোগ এনে এর প্রতিবাদে গেলো দুই মাসে বিক্ষোভ-সমাবেশও করেছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষরা।এসব সমাবেশগুলোতে রাজনীতি নিয়ে এমনসব বক্তব্য উঠে আসছে, যেগুলো এর আগে সেভাবে শোনা যায়নি।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত যেসব হিন্দু নেতাদের এতোদিন সামনে দেখা যেত, এসব বিক্ষোভে তাদের উপস্থিতি দেখা যায়নি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ঠিক কী দাবিতে এমন বড় আয়োজনে বিক্ষোভ করছেন সনাতন ধর্মের অনুসারীরা? আর এসব বিক্ষোভের মাধ্যমে কী বার্তা দিতে চাচ্ছেন তারা?
সাম্প্রতিককালে ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরে সনাতন ধর্মানুসারীদের বিভিন্ন সমাবেশে যেভাবে হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে, তাকে সংখ্যালঘু নেতারা ব্যাখ্যা করছেন ব্যাপক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে।অনেকটা তাৎক্ষণিক এসব বিক্ষোভ আলোড়ন তুলেছে হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে।
শুরুতে বিভিন্ন সংগঠন বিচ্ছিন্নভাবে বিক্ষোভের আয়োজন করলেও পরে এটা করা হচ্ছে সমন্বিতভাবে ‘সম্মিলিত সংখ্যালঘু জোটে’র ব্যানারে।
তবে বাংলাদেশে হিন্দুদের মন্দির কিংবা বাড়িঘরে হামলার ঘটনা নতুন নয়। এর আগে বিভিন্ন সময় এরকম ঘটনা ঘটলেও তখন সংখ্যালঘুদের এতো বড় আয়োজনে বিক্ষোভ দেখা যায়নি।কিন্তু এবার তাহলে সারাদেশে হিন্দু জনগোষ্ঠীর অনেকেরই এমন বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠার কারণ কী?
সম্মিলিত সংখ্যালঘু জোটের উপদেষ্টা অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস বলছেন, আমাদের আসলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এই অনুভূতিটাই সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে সবাই সামনে এসে নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
তিনি বলছেন, এর আগে যেসব হামলা হয়েছে, সেগুলো হয়েছে অনেকটা নির্দিষ্ট এলাকায় বা নির্দিষ্ট গ্রামে। সেটারও একটা প্রভাব তখন দেখা গেছে। কিন্তু হামলার ব্যাপকতা এবারে যেন সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে এটা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। ফলে এই সময়েই একটা ভীষণ ভয়, হতাশা, আতঙ্ক চলে আসলো সবার মনে। সকলেই বলছিলো, এমনকি আমার গ্রামেও এরকম কথা কেউ এর আগে বলেনি। সেটা হচ্ছে যে, আমরা মনে হয় আর থাকতে পারবো না। এই যে আতঙ্ক সেটাই মানুষকে সংঘবদ্ধ হতে সাহায্য করেছে।কারো ইন্ধনে আন্দোলন করছি না।
এবারে ঢাকা কিংবা ঢাকার বাইরে সংখ্যালঘুদের জমায়েতে বেশি অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে মূলত তরুণ-যুবকদের। আর এর পেছনে মূল ভূমিকা রাখছেন ছাত্ররা।বড় সমাগমের পাশাপাশি বিক্ষোভগুলোতে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, সেটা হচ্ছে, রাজনৈতিক পরিচয় আছে এমন নেতাদের অংশগ্রহণ নেই।এমনকি গেলো দুই দশকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদেরকেও সমাবেশে দেখা যায়নি।
অন্যদিকে আন্দোলনে সাধারণ হিন্দুদের পাশাপাশি সাধু-সন্তুদের সক্রিয় ভূমিকা দেখা গেছে।আন্দোলনের সংগঠকরা জানাচ্ছেন, আন্দোলনে যেন কোনো রাজনৈতিক চোহারা না থাকে, কেউ যেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে একে ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য তারা সচেতন আছেন।
এই আন্দোলনের একজন সংগঠক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নির্মল বিশ্বাস বলছেন, যারা আগে রাজনৈতিক পদধারী ছিলেন বা রাজনীতির লেবেল আছে, তাদেরকে আমরা সামনে আনছি না। এবং তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবেও সামনে আসছেন না। যারা বিভিন্ন সময় সরকারদলীয় ছিলেন, তাদের আমাদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার দরকার নাই। আমরা আমাদের মতো রাজপথে আন্দোলন করে যাবো, তারা যেন বিঘ্ন তৈরি না করে।
কিন্তু এর মাধ্যমে কী অর্জন করতে চান তারা এমন প্রশ্নে জবাবে তিনি বলছেন, আন্দোলন যেন বিতর্কিত না হয় সেজন্যই তারা রাজনীতিসংশ্লিষ্টদের দূরে রাখছেন।
তার ভাষ্য, অনেকে হয়তো এটা বলবে যে, আওয়ামী লীগ সরকারকে ফিরিয়ে আনতে আন্দোলন করছে সংখ্যালঘুরা। আমরা আওয়ামী লীগ সরকারকে ফিরিয়ে আনার আন্দোলন করছি না।কিন্তু রাজনীতিসংশ্লিষ্টরা এখানে থাকলে আমাদেরকে ট্যাগ দিয়ে দমন করার ষড়যন্ত্র হতে পারে। আমাদের তো দেশকে অস্থিতিশীল করার কোনো টার্গেট বা অভিপ্রায় নেই। কারোও ইন্ধনেও আমরা রাজপথে নামি নাই। আমরা মাঠে নেমেছি শুধুমাত্র আমাদের আট দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য। এটাই আমাদের উদ্দেশ্য।
আওয়ামী লীগের ‘ভোটব্যাংক’ তকমা কাটাতে চান হিন্দু নেতারা
সংখ্যালঘু জোটের আন্দোলনে যে আট দফার কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো অবশ্য নতুন নয়। এর আগে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংগঠন এসব দাবি বিচ্ছিন্নভাবে তুলে ধরেছেন।
তবে এখন গুরুত্বপূর্ণ দাবিগুলো একসঙ্গে করে আট দফা দাবি নামে এর বাস্তবায়ন চান হিন্দু নেতারা। যেখানে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচারে তদন্ত কমিশন গঠন, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন কিংবা আলাদা মন্ত্রণালয় গঠনের দাবি জানানো হচ্ছে।
পাশাপাশি দেবোত্তর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য উপাসনালয় নির্মাণের পাশাপাশি দুর্গাপূজায় পাঁচ দিনের ছুটি চাওয়া হয়েছে।কিন্তু এই আন্দোলন এমন একটি সময়ে হচ্ছে, যখন নতুন একটি অন্তর্র্বতীকালীন সরকার ক্ষমতায়।
ফলে আন্দোলনের উদ্দেশ্য নিয়ে যেমন অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, তেমনি আওয়ামী লীগের ‘ভোট ব্যাংক’ হিসেবে হিন্দুদের উল্লেখ করে এই আন্দোলনের পেছনে ভারত বা আওয়ামী লীগের উস্কানি আছে এমন প্রচারণাও আছে বিভিন্ন মহলে। যদিও এসব প্রচারণাকে নাকচ করে দিচ্ছেন সংখ্যালঘু নেতারা।
বাংলাদেশ হিন্দু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুমন কুমার রায় বলছেন, তাদের যে দাবি সেটা মানতে আওয়ামী লীগ সরকার তো বটেই অতীতের কোনো সরকারই কোনো সদিচ্ছা দেখায়নি।
সুমন কুমার রায় বিবিসি বাংলাকে বলেন, ২০০১ সাল থেকে আজকে ২০২৪ সাল। হিন্দুদের ওপর যতগুলো অত্যাচার-নির্যাতন করা হয়েছে, একটা ঘটনারও সুষ্ঠু তদন্ত, বিচার কোনোটাই হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার টানা ষোল বছর ক্ষমতায়, আমরা ভেবেছিলাম, তারা আমাদের দাবিকে গুরুত্ব দেবে। কিন্তু বাস্তবে আসলে কিছুই হয়নি।
তিনি বলছেন, বলা হয় যে, আওয়ামী লীগ হিন্দু বান্ধব, হিন্দুরা আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। কিন্তু তার প্রতিফলন তো আমরা দেখিনি। আবার হিন্দুদের সবাই যে আওয়ামী লীগকে পছন্দ করে বিষয়টাও তেমন না। তাহলে সাতক্ষীরা, চট্টগ্রামের মতো বিভিন্ন জায়গায় বিএনপি কিংবা জামায়াতের নেতারা অতীতে কীভাবে নির্বাচিত হয়েছেন? তারা তো অবশ্যই হিন্দুদের ভোট পেয়েছেন। সুতরাং হিন্দুরা শুধু আওয়ামী লীগকে ভোট দেয় এটা আমি মনে করি অমূলক ধারণা।
সুমন কুমার রায় অবশ্য এটাও দাবি করছেন, যে কোনো নির্বাচনের আগে-পরে সংখ্যালঘুরা সব দলের কাছেই বলির পাঠায় পরিণত হন তারা।
তার ভাষ্য, ভোটে আওয়ামী লীগ প্রার্থী যদি হেরে যায়, তাহলে তারা এসে হিন্দুদের মারধর করে, অগ্নিসংযোগ করে, ভাঙচুর করে। বলে যে, মালাউনেরা ভোট দেয়নি এজন্য হেরে গেছি। আবার বিএনপি প্রার্থীও হেরে গেলে তারাও বলে যে, এই মালাউনেরাই আমাদের ভোট দেয়নি, সেজন্য হেরি গেছি। অতএব রাজনৈতিকভাবে আমরা যেন একটা বলির পাঠা।
আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের কথায় এটা স্পষ্ট যে, হিন্দুদের ওপর আওয়ামী লীগের সমর্থক কিংবা ভারতপন্থী যে তকমা সেটার অবসান ঘটাতে চান তারা। কিন্তু সেটা কীভাবে হবে?
এমন প্রশ্নে আন্দোলনের নেতারা বলছেন, তারা এখন চেষ্টা করছেন রাজনীতির বাইরে থাকার।
তাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, অতীতে হিন্দু সম্প্রদায়েরও অনেকে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ না দেখে বরং হিন্দু পরিচয়কে দলীয় রাজনীতিতে ব্যবহার করেছেন। এতে ওই সব নেতারা লাভবান হলেও হিন্দুদের কোনো দাবি পূরণ হয়নি। বরং হিন্দুরা বিভিন্ন সময় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
গত ৪ আগস্ট, ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সংখ্যালঘু জোটের সর্বশেষ যে সমাবেশ হয়েছে, সেখানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে চট্টগ্রামের ইসকন নেতা এবং পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস বলেছেন, হিন্দুদেরকে আর কেউ নির্দিষ্ট কোনো দলের লেজুড়বৃত্তিতে ব্যবহার করতে পারবে না।
তিনি বলেন, আমরা এখন থেকে সমস্ত বাংলাদেশে ভোটের আগে যারা আমাদের অধিকার নিয়ে, আমাদের দাবি নিয়ে কাজ করবেন, আমরা সমন্বিতভাবে তাদেরকেই ভোট দেবো। কোনো দলের লেজুড়বৃত্তি আমরা হিন্দুরা কেউ করবো না। যারা হিন্দু নাম নিয়ে এটা করতে চাইবে, আমরা তাদেরকে সামাজিকভাবে বর্জন করবো।
আট দফা দাবি নিয়ে সরকার কী বলছে?
এবার পূজার আগে সরকার একদিনের ছুটি বাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও হিন্দু সম্প্রদায়ের দাবি ছিল পূজা উপলক্ষ্যে পাঁচ দিন ছুটি দেওয়া হোক। কিন্তু সেটা হয়নি। এছাড়া পুরো আট দফা দাবি নিয়েও আলাদা কোনো আশ্বাস সংখ্যালঘু সম্প্রদায় পায়নি বলে জানাচ্ছেন নেতারা।
যদিও সংখ্যালঘু নির্যাতন, পূজায় নিরাপত্তাসহ বিভিন্নভাবে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে এবং ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু আলোচনার কথা জানা যাচ্ছে।
কিন্তু নির্দিষ্টভাবে আট দফা দাবি পূরণের বিষয়ে সরকার আসলে কী ভাবছে?
জানতে চাইলে ধর্ম উপদেষ্টা অবশ্য জানিয়েছেন এসব দাবি সরকারের বিবেচনায় আছে।
তিনি বলছেন, উনারা দাবি জানিয়েছেন এবং প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সনাতম ধর্ম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার আলোচনা হয়েছে। আমাদের সময় কম। এগুলো করতে গেলে নির্বাচিত সরকার লাগে, সময় লাগে। আমরা তো ইন্টেরিম গভর্নমেন্ট। বিতর্ক তৈরি হয় এরকম কোনো কাজে সরকার এখন হাত দিচ্ছে না। আর যেগুলো সময়সাপেক্ষ সেগুলো এক দিনে হয় না। দৈনন্দিন কাজ করতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। উনারা দাবি জানিয়েছেন। এগুলো সরকারের বিবেচনায় আছে।
তবে সরকার যেটাই করুক, হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা বলছেন, তাদের ভাষায় নির্যাতন-বঞ্চনার একটা চক্রে পড়ে গেছেন তারা। যেটার অবসান জরুরি। এর জন্য নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং সনাতনীদের মধ্যে নতুন ধরনের ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে।
আন্দোলনকারীদের মধ্যে এমন অনেক কথাই এখন শোনা যাচ্ছে যেটা আগে সেভাবে বলা হয়নি।
কিন্তু একদিকে যখন সনাতন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার হওয়া নিয়ে ক্ষোভ এবং আট দফা দাবিতে নতুন আন্দোলন দেখা যাচ্ছে, তখন এসব দাবি বাস্তবায়নে সরকার থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
ফলে সংখ্যালঘু নেতারাও আন্দোলন থেকে সরে না এসে বরং আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিচ্ছেন।