মুক্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে পাইকারি গ্রেপ্তারের পাশাপাশি গণহারে মামলার সাজা দেওয়া শুরু হয়। ওই সময় প্রায় দুই হাজার নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন ঢাকার বিভিন্ন আদালত। এর মধ্যে মৃত আর গুমের শিকার নেতাকর্মীও বাদ যাননি।
এ ধরনের চার গায়েবি মামলায় সাড়ে ১২ বছরের সাজা হয় স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসানের বিরুদ্ধে। তাঁর বিরুদ্ধে বিগত ১৭ বছরে ২১২টি রাজনৈতিক মামলা রয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অনেক কিছুর পট পরিবর্তন আর রদবদল হলেও রাজীবের মামলার ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখনও তাঁকে ওইসব রাজনৈতিক মামলায় নিয়মিত আদালতের এক বারান্দা থেকে আরেক বারান্দায় ছুটতে হচ্ছে। আগের মতো গ্রেপ্তার আতঙ্ক না থাকলেও মামলার ভাগ্য নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি। ফেরারি জীবন থেকে খোলা বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারলেও অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতায় এখনও শিউরে ওঠেন রাজীবসহ তাঁর পুরো পরিবার। এসব মামলায় না জানি কখন কী হয়– এমন ভাবনায় আতঙ্কে কাটে তাদের সময়।
মাত্র তিন বছর বয়সী ছেলে ফাইয়াজ মাসুদকে রেখে বিদেশে পাড়ি দিতে হয়েছিল ঢাকা মহানগর যুবদলের সাবেক সদস্য মাসুদ রানাকে। তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে ৩৭টি রাজনৈতিক মামলা। প্রতিটি মামলাতেই রয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী বক্তব্য দেওয়ার পর জীবন বাঁচাতে ২০১৯ সালের এপ্রিলে পাড়ি দেন যুক্তরাষ্ট্রে। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে দেশের মানুষের মুক্তি মিললেও দেশে ফিরতে পারছেন না তিনি। মামলা জটিলতায় বিদেশে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন, কবে মামলার অবসান ঘটবে। কবে দেশে ফিরতে পারবেন, আবার কবে সন্তানকে কোলে নিয়ে আদর করতে পারবেন মাসুদ।
এই অবস্থা শুধু রাজীব ও মাসুদের নয়, দেশের প্রায় প্রত্যেক নেতাকর্মীকে ভয়ানক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। মামলা আর জেলজুলুমে প্রত্যেককে কষ্টের জীবন পার করতে হয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেশ ফ্যাসিবাদমুক্ত হয়েছে। দলমত নির্বিশেষে সবাই যখন খোলা বাতাসে, তখন শুধু ব্যতিক্রম বিএনপি নেতাকর্মী। তাদের কাঁধে এখনও প্রায় দেড় লাখ মামলার বোঝা। এ নিয়ে তারা রয়েছেন আতঙ্কে।
বিএনপির দপ্তর সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের পর গত ৫ জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ১ লাখ ৪২ হাজার ৯৮৩ মামলায় ৫৯ লাখ ২৯ হাজার ৪৯২ জনকে আসামি করা হয়েছে। শুধু গত বছরের ২৮ অক্টোবর থেকে তিন মাসের মধ্যে সারাদেশে ১ হাজার ৬৪৫ মামলায় প্রায় ৭০ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছিল। যার মধ্যে ২৫ হাজার ৭১১ জনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নেওয়া হয় ওই সময়ে।
আরও পড়ুন : “জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে নিরাপত্তার বলয়: পুলিশ ও সেনাবাহিনীর টহলদারি!”
নেতাকর্মীরা জানান, গণঅভ্যুত্থানের পর যখন অন্যরা ফুরফুরে মেজাজে, তখন আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হচ্ছে তাদের। তবে এতটুকুই সান্ত্বনা– এখন আর গ্রেপ্তারের আতঙ্ক নেই, গুম-খুনের ভয় নেই। স্বাভাবিক জীবনে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাস করতে পারছেন তারা।
তিন বছরের সাজা মাথায় নিয়ে ঘুরছেন বরিশাল স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম জনি। এ মামলার জন্য তাঁর পুরো রাজনৈতিক জীবন তছনছ হয়ে গেছে। গত বছরের ২৮ অক্টোবর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে একদিকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত, অন্যদিকে ঢাকার একটি আদালতে সাজার রায় ঘোষণায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। মাত্র কয়েক দিনের আত্মগোপনে থাকায় তাঁকে পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তৃণমূলের ছাত্র রাজনীতি থেকে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে জেলার দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি। তবে মামলার রায় ঘোষণার এক দিনের মাথায় সেই পদও চলে যায়। স্বৈরাচারমুক্ত দেশে এখন তাঁকে সেসব মামলার ঘানি টানতে হচ্ছে। যে মামলায় তাঁর তিন বছরের সাজা হয়েছে; সেই মামলা নিষ্পত্তির জন্য বড় অঙ্কের টাকার দাবি করা হচ্ছে বলে আক্ষেপ করেন জামিনে থাকা এ নেতা।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমকালকে বলেন, ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলসহ অন্যান্য অঙ্গসংগঠন ছাড়াও মূল দলের সবার বিরুদ্ধে সব মামলা প্রত্যাহার না হলে কখনোই একটা নিরপেক্ষ অবস্থা তৈরি হবে না। অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে এসব রাজনৈতিক মামলা। স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে যারা নিহত ও আহত হয়েছেন, তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা এবং মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
দলটির নেতাকর্মীরা জানান, ওয়ান-ইলেভেন থেকে শুরু হয় বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলার খড়্গ। জুলাই-আগস্টের আগে কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি পার হয়ে চার শতাধিক পর্যন্ত রাজনৈতিক মামলা দেওয়া হয়। গত কয়েক বছরের মামলার ভারে তৃণমূল বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অনেক পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে এসব মামলায়। বিরোধী দলকে দমন করতে মামলাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এসব মামলার কারণে অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি হারিয়ে উদ্বাস্তু জীবনযাপন করতে বাধ্য হন। গ্রামগঞ্জের নেতাকর্মীর কেউ ঢাকায় রিকশাচালক হয়েছেন, কেউ হকার আবার কেউ দারোয়ানের মতো কাজ জুটিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। দীর্ঘ ১৭ বছরে এ রকম জীবনযুদ্ধে পার হয়েছে তাদের সোনালি সময়। তবে ফ্যাসিবাদমুক্ত দেশে এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছেন না তারা।
বিএনপি নেতারা জানান, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্র্বতী সরকারের কার্যক্রম অনেকটা ধীরগতির। এতে নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তাদের। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, বিগত ১৭ বছরে বিএনপিসহ বিভিন্ন বিরোধী দল ও মতের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও হয়রানিমূলক মামলার বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত নিতেই অনেক সময়ক্ষেপণ হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের দেড় মাস পর বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারে জেলা ও মন্ত্রণালয় পর্যায়ে দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব কমিটি জেলা ও মহানগর পর্যায়ে মামলার তথ্য সংগ্রহ করবে। এর পর আইন মন্ত্রণালয় সেসব মামলা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। আন্দোলনের ফসল হিসেবে সবাই স্বাধীনতা পেলেও বিএনপি নেতাকর্মীরা এর ব্যতিক্রম। মামলার ফাঁদে আটকে পড়ে আছেন তারা।
বিএনপির মামলা ও গুম-খুনের সেলের কর্মকর্তা সালাহউদ্দিন আহমেদ জানান, সারাদেশে বিএনপি নেতাকর্মীর মামলার প্রকৃত অবস্থান ও পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরিতে একটি নিজস্ব সেল গঠন করা হয়েছে। ছয় সদস্যের ওই সেল দিনরাত কাজ করছে। খুব শিগগির এই কাজ সম্পন্ন হবে। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারে জেলা ও মন্ত্রণালয় পর্যায়ে দুটি কমিটি গঠন করেছে অন্তর্র্বতী সরকার। আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সেখানে মামলার সব তথ্য দাখিলের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তবে সেখানে বিএনপির কোনো নেতাকর্মীর নামে থাকা কোনো মামলা যাতে বাদ না যায়, সে জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে তারা তালিকা করছেন। ওই তালিকায় মামলার সর্বশেষ অবস্থান, সাজা, চার্জশিট থেকে সবকিছু উল্লেখ থাকবে, যাতে মামলার শিকার সব পর্যায়ের নেতাকর্মী এই সুবিধা পান। এ জন্য দেশের প্রত্যেক নেতাকর্মীকে মামলার কপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জমা দিতে বলা হয়েছে। তালিকায় যেসব নেতাকর্মী মামলার কারণে দেশের বাইরে দেশান্তরী হয়েছেন, তাদের বিষয়ে স্বজন কিংবা মামলায় থাকা অন্য নেতাকর্মীকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে দলটি।