এক সময় রিকশা চালাতেন আবুল কালাম আজাদ। কোনো রকমে চলতো সংসার। এখন তিনি মোটরসাইকেল চোরদের ‘গুরু’। নিজেকে দাবি করেন ‘সেরা চোর’। কারণ যেকোনো মোটরসাইকেলের তালা/লক ভাঙা তার জন্য এক মিনিটের ব্যাপার। ডিবি পুলিশের ডিবি তালিকায় তিনি ‘দুর্ধর্ষ’ চোর। তার অন্তত ১০ জন ‘শিষ্য’ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মোটরসাইকেল চুরির জন্য চক্র গড়ে তুলেছে।
ডিবি পুলিশ বলছে, ১৩ বছরে দুই শতাধিক মোটরসাইকেল চুরি করেছেন আবুল কালাম আজাদ। তার বিরুদ্ধে ৫৩টি মোটরসাইকেল চুরির মামলা আছে। তিনি গ্রেফতার হয়েছেন অন্তত ৪৫ বার। গ্রেফতার হওয়ার এক মাসের মধ্যে জামিনে মুক্ত হয়ে আবারো মোটরসাইকেল চুরি শুরু করেন তিনি।
সবশেষ, ৫ অক্টোবর কারাগার থেকে মুক্তি পান আবুল কালাম আজাদ। এরপর ওয়ারী অঞ্চলে অন্তত ৮টি মোটরসাইকেল চুরি করেন। গত মঙ্গলবার যাত্রাবাড়ী এলাকায় চার সহযোগীসহ ডিবি পুলিশের হাতে আবারো গ্রেফতার হন তিনি।
ডিবি পুলিশের ওয়ারী অঞ্চলের সহকারী কমিশনার (এসি) মাহফুজুর রহমান বলেন, ওয়ারী অঞ্চলের কয়েকটি মোটরসাইকেল চুরির মামলা তদন্ত করতে গিয়ে আবুল কালামের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। পরে অভিযান চালিয়ে তিনিসহ চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে দুটি মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়েছে।
যেভাবে ‘দুর্ধর্ষ’ চোর হলেন কালাম
প্রায় ৩০ বছর আগে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসেন আবুল কালাম আজাদ। ঢাকায় এসে শুরুর দিকে দিনমজুর হিসেবে কাজ করেছেন। পরে ভ্যানে সবজি বিক্রি করেছেন। এক সময় রিকশা চালানো শুরু করেন। ২০১০ সালে তার রিকশাটি চুরি হয়। সেই রিকশা তিনি খুঁজেও পান। তবে চোর চক্র রিকশাটি ফিরিয়ে দিতে ৪ হাজার টাকা দাবি করে। সেই টাকা তিনি দিতে পারেননি।
আবুল কালাম আজাদ জানান, চোর চক্রের সদস্যরা তাকে তাদের দলে যোগ দিতে বলে। পরিশ্রম ছাড়াই বেশি অর্থ উপার্জনের প্রলোভন দেখায়। এরপর তিনি রিকশা চুরি শুরু করেন। প্রথম রিকশা চুরির পর ১ হাজার টাকা পেয়েছিলেন।
দুই বছর পর রিকশা চুরি করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন কালাম। কারাগারে গিয়ে খালেক নামে এক মোটরসাইকেল চোরের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। খালেকের পরামর্শে তিনি মোটরসাইকেল চুরিতে উদ্বুদ্ধ হন। কারাগার থেকে বেরিয়ে খালেকের সঙ্গে থেকে মোটরসাইকেল চুরির কৌশল শেখেন। প্রথম মোটরসাইকেল চুরির পর তিনি ৪ হাজার টাকা পেয়েছিলেন। ধীরে ধীরে মোটরসাইকেল চুরিতে পারদর্শী হয়ে ওঠেন আবুল কালাম আজাদ।
ডিবি পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) আব্দুল আহাদ বলেন, আবুল কালাম আন্তজেলা চোরচক্রের হোতাদের একজন। তার নেতৃত্বে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মোটরসাইকেল চোর চক্রের সদস্যরা সক্রিয় রয়েছে। তাকে গ্রেফতারের পর চোর চক্র সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। তাকে এক দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। ওয়ারী এলাকায় ৮টি মোটরসাইকেল চুরির বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
যে কারণে নিজেকে ‘সেরা চোর’ দাবি করেন কালাম
কমপক্ষে ৪৫ বার গ্রেফতার হয়েছেন আবুল কালাম আজাদ। গ্রেফতারের এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে জামিনে মুক্ত হন। একবার জামিন পেতে খরচ হয় ২০ হাজার টাকা। গ্রেফতার হলে তার স্ত্রী জামিনের ব্যবস্থা করেন।
আবুল কালাম আজাদ সাধারণত বিভিন্ন বাসার গ্যারেজ থেকে মোটরসাইকেল চুরি করেন। তিনি নিজে মোটরসাইকেল চালাতে পারেন না। এ কারণে চুরির সময় সঙ্গে একজন চালক রাখেন। চুরির আগে তিনি বিভিন্ন এলাকায় ‘রেকি’ করে নিরাপত্তাব্যবস্থা কম বা নিরাপত্তায় ফাঁক আছে এমন বাড়ি খুঁজে বের করেন। যখন বাড়ির গেটে কেউ থাকে না, তখনই তিনি মোটরসাইকেলের তালা ভেঙে চুরি করেন।
একটি মোটরসাইকেলের তালা ভাঙতে তিনি সময় নেন মাত্র এক মিনিট। মোটরসাইকেলে ‘ঢালাই তালা’ লাগানো থাকলে সেটি তিনি ‘চোখের পলকে’ ভেঙে ফেলেন বলে দাবি করেন। তালা ভাঙার পর মোটরসাইকেলের একটি তার কেটে সেটি দ্রুত চালু করে মোটরসাইকেল নিয়ে পালিয়ে যান।
আবুল কালাম আজাদের দাবি, মোটরসাইকেল চুরিতে তার মতো পারদর্শী আর কেউ নেই। তার কাছ থেকে মোটরসাইকেল চুরি শিখে এখন অনেকে বড় চোর হয়েছে। তারা এখন আলাদা আলাদা চক্র গড়ে তুলেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় চোর মাদারীপুরের শিবচরের জসীম উদ্দিন। শাহ আলম, মানিক, রাকিব, জহির, রহিম, ফায়জুল, মারুফ, রাসেল ও রাশেদ তার কাছ থেকে চুরি শিখে আলাদা চক্র গড়ে তুলেছে। এই ‘শিষ্যদের’ সঙ্গেও কারাগারেই পরিচয় হয়েছে আবুল কালাম আজাদের। চুরির পর মোটরসাইকেল নোয়াখালী, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, ফেনী ও কুমিল্লা এলাকায় পাঠিয়ে দেন তিনি। একটি মোটরসাইকেল ২৫ থেকে ৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেন।
ভাগ্য পরিবর্তনে ব্যর্থ ‘সেরা চোর’ কালাম
দুই শতাধিক মোটরসাইকেল চুরি করেও ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি আবুল কালাম আজাদের। মোটরসাইকেল চুরি করে উপার্জন করা অর্থের বড় একটি অংশ মামলার পেছনেই খরচ হয়েছে। বিভিন্ন সময় তার অন্তত ১০ জন কথিত স্ত্রী ছিল। তাদের সঙ্গে বসবাসের সময় অনেক অর্থ খরচ হয়েছে। তবে এখন আর এসব কথিত স্ত্রী নেই। তার প্রথম স্ত্রী ও তিন সন্তান নারায়ণগঞ্জে বসবাস করেন। বড় মেয়ের বিয়ে হলেও এখন স্বামীর সঙ্গে থাকে না। ছোট মেয়ে এবং আরেক ছেলে পোশাক কারখানায় চাকরি করে। সন্তানরা এখন তার পরিচয় দিতে চায় না। চুরি ছেড়ে দিতে বলে, কিন্তু মোটরসাইকেল চুরি তার নেশায় পরিণত হয়েছে। কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে চুরি না করলে সহযোগীরাই পুলিশকে তথ্য দিয়ে তাকে ধরিয়ে দেয়।