দেশে বৈধ যানবাহন আছে ৬২ লাখের মতো। আর সরকারের বিবেচনায় ‘অবৈধ’ তিন চাকার যানবাহন আছে প্রায় ৭০ লাখ। বৈধ যানের ২ শতাংশের কম বাস-মিনিবাসসহ গণপরিবহন। চাহিদার তুলনায় গণপরিবহনের এই স্বল্পতার সুযোগে কারিগরিভাবে ত্রুটিপূর্ণ তিন চাকার ব্যাটারি ও ইঞ্জিনচালিত রিকশায় ঢাকাসহ সারা দেশ ছেয়ে গেছে। এসব যান বাড়তে দিয়ে এখন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বরং ত্রুটিপূর্ণ এই যানবাহনগুলো দুর্ঘটনা বাড়াচ্ছে।
গত মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর এলাকার সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চলাচল তিন দিনের মধ্যে বন্ধ বা বিধিনিষেধ আরোপ করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, ঢাকার জেলা প্রশাসক, দুই সিটি করপোরেশনের প্রশাসক, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ওই দিন রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ধাক্কায় আফসানা করিম নামের এক ছাত্রী নিহত হন। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, সড়কে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। প্রাণহানির দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে তিন চাকার যানবাহনের দুর্ঘটনা। গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৫৯৮ জন মারা গেছেন। যানবাহনভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে মোটরসাইকেলচালক ও আরোহী ১ হাজার ৯২৪ জন; যা মোট নিহত হওয়া মানুষের ৩৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। আর তিন চাকার যানবাহন সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ইজিবাইক, নছিমন, অটোভ্যান ইত্যাদির দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৯৭ জন মারা গেছেন; যা মোট নিহত মানুষের ১৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ। সরকার নিবন্ধন দেয় না বলে এগুলোকে অবৈধ যানবাহন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এহসানুল হক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এখনো আদালতের আদেশ পাননি। পেলে পরবর্তী করণীয় ঠিক করবেন।
ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও অন্যান্য অবৈধ তিন চাকার যানবাহনের প্রকৃত হিসাব সরকারের কোনো দপ্তরেই নেই। তবে ২০১০ সালের দিকে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একাধিক বৈঠকে তিন চাকার অবৈধ যানের সংখ্যা ১০ লাখের মতো বলে উল্লেখ করা হয়। বিআরটিএ, যাত্রী অধিকার সংগঠন, পুলিশ ও অন্যান্য অংশীজনের হিসাবে, ব্যাটারি ও যন্ত্রচালিত তিন চাকার অবৈধ যানবাহন এখন ৬০ লাখের বেশি। এর মধ্যে ঢাকার বাইরে আছে প্রায় ৫০ লাখ। আর ঢাকায় আছে ১০ লাখের মতো। কেউ কেউ মনে করেন, ব্যাটারি ও যন্ত্রচালিত রিকশার সংখ্যা ১৫ লাখের কম হবে না।
তিন চাকার এই যানবাহনগুলোর কাঠামোগত ও যান্ত্রিক ত্রুটি রয়েছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদীউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, নানা ত্রুটিযুক্ত বিপুল পরিমাণ এসব যানের চলাচল নিঃসন্দেহে ঝুঁকিপূর্ণ। তবে এই যানবাহনগুলোর সঙ্গে যে পরিমাণ মানুষ যুক্ত রয়েছে এবং যেভাবে ছড়িয়েছে, তা হুট করে বন্ধ করা যাবে না। তাঁর সুপারিশ হচ্ছে—এটিকে নীতিমালার আওতায় এনে কারিগরিভাবে উন্নয়ন করা যেতে পারে। কোন কোন সড়কে, কী পরিমাণে চলতে দেওয়া হবে, এর একটা বিস্তারিত পরিকল্পনা থাকা দরকার।
অবৈধ যানের দাপট বেশি
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ২০ ধরনের যানবাহনের নিবন্ধন দেয়। গত অক্টোবর পর্যন্ত নিবন্ধিত যানবাহন হচ্ছে ৬২ লাখ। এর মধ্যে গণপরিবহনের মূল বাহন বাস-মিনিবাস আছে মাত্র ৮৪ হাজার। যা মোট নিবন্ধিত যানের ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। তিন চাকার যানবাহনের মধ্যে শুধু অটোরিকশা ও অটোটেম্পোর নিবন্ধন দেয় বিআরটিএ। এ দুটি যানের বৈধ সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ৪২ হাজার।
অন্যদিকে নিবন্ধিত যানবাহনের বাইরে ৬০ থেকে ৭০ লাখ তিন চাকার ছোট যানবাহন চলাচল করে। এগুলোকে সরকার অবৈধ হিসেবে বিবেচনা করে। এসব যানের মধ্যে রয়েছে নছিমন, করিমন, আলমসাধু, ভটভটি, ইজিবাইক ও পাখি। সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে ব্যাটারি বা যন্ত্রচালিত রিকশা।
অবৈধ বলে রাজনৈতিক প্রভাব
সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রায় এক যুগ দায়িত্ব পালনকালে একাধিকবার প্রকাশ্যে বলেছেন, অবৈধ তিন চাকার যানবাহন চলাচলের পেছনে স্থানীয় প্রভাবশালী বা রাজনীতিকেরা জড়িত। এ জন্য এই যান বন্ধ করা যাচ্ছে না।
অবৈধ এই যানের চলাচল বহাল রাখতে বিপুল চাঁদা দিতে হয় চালক-মালিকদের। আর এই চাঁদার ভাগীদার পুলিশ ও রাজনীতিকেরা। গত সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এই চাঁদার নিয়ন্ত্রণ করতেন।
২০১০ সালের দিকে রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রথমে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচলের অনুমোদন দেন সাবেক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। রাজশাহী ছাড়াও দেশের কিছু কিছু পৌরসভা ও ইউনিয়ন এলাকায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা কিছু কিছু তিন চাকার যানের নিবন্ধন দিয়েছেন। এগুলোর কারিগরি কোনো সমীক্ষা করেননি তাঁরা।
বারবার সরে আসে সরকার
গত ১৫ মে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের এক সভায় তৎকালীন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঢাকায় ব্যাটারি বা যন্ত্রচালিত রিকশা বন্ধের নির্দেশনা দেন। এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে রাজধানীর আগারগাঁও ও মিরপুর-১০ নম্বরে সড়ক অবরোধসহ ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন এসব যানের চালকেরা। ২০ মে মন্ত্রিসভার বৈঠকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘নিম্ন ও স্বল্প’ আয়ের মানুষের কথা চিন্তা করে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেন।
বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলছেন, শেখ হাসিনার ওই সিদ্ধান্তের পর ঢাকাসহ সারা দেশে অবৈধ এসব যান স্রোতের মতো নামতে শুরু করে। এসব রিকশা আগে চলত অলিগলিতে। এখন মূল সড়কে নেমে গেছে।
অবৈধ তিন চাকার যানবাহন নিয়ন্ত্রণে বুয়েটের অধ্যাপক হাদীউজ্জামান বলেন, গোড়া থেকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ভালো হতো। এখন তিন চাকার যানগুলোর সংযোজন, নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবসার সঙ্গে স্থানীয় রাজনীতিকেরা জড়িয়ে পড়েছেন। ফলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে।