বিশ্ববাজারে হ্রাস পাচ্ছে পণ্যের দাম, কমে আসছে মূল্যস্ফীতি। কিন্তু এত কিছুর পরেও বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি এখনো লক্ষ্য অর্জন থেকে অনেক দূরে। ঠিক কী কারণে দেশে মূল্যস্ফীতি সামাল দেয়া যাচ্ছে না এবং কী করলে মূল্যস্ফীতির হার সহনশীল অবস্থায় নামিয়ে আনা যাবে এটিই এখন সবার প্রশ্ন।
চলতি বছর মে মাসে দেশের মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ, যা ভেঙেছে বিগত ১১ বছরের রেকর্ড। পরের মাসে অর্থাৎ জুনে মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ নামলেও এখনো রয়ে গেছে মানুষের অসহনীয় পর্যায়ে।
বাজারে মূল মূল্যস্ফীতির থেকেও বেশি ভোগাচ্ছে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি। বিশেষ করে নিম্ন, নিম্নমধ্যম এবং মধ্যম আয়ের মানুষের ভোগান্তির মূল কারণ বাজারে বিরাজমান অস্থিরতা। ক্রেতারা বলছেন, হাজার টাকার নোট নিয়ে বাজারে গেলেও ফিরে আসতে হয় অর্ধেক বাজার করে। দুই বছর আগে এক হাজার টাকায় যা কেনা যেত এখন তার অর্ধেক পণ্য কিনতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে।
যেখানে দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখনো নয় শতাংশের ওপরে, একবার বাড়ে পেঁয়াজের দাম, আরেকবার কাঁচা মরিচের, কখনোবা ডিম কিংবা মুরগির মাংস, আবার কখনো কেজিতে মাছের দাম বাড়ে ৫০০ টাকা পর্যন্ত সেখানে কী করলে বাজার স্বাভাবিক হবে এমন প্রশ্ন ছিলো অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশের কাছে। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে হলে শুরুতেই বুঝতে হবে উৎপাদন ও বিপণনের মধ্যে পার্থক্য কতখানি। এই পার্থক্য কমিয়ে আনতে পারলে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব।
আমদানির পরেও কেন পণ্যের দাম কমতে এত সময় লাগে জানতে চাইলে আকাশ বলেন, যারা মূলত পণ্য আমদানি করেন তাদের আলাদা সিন্ডিকেট আছে। এসব সিন্ডিকেটের কারণে দেশের বাজারে পণ্যের দাম একবার বেড়ে যাওয়ার পর, আমদানি করা হলেও দাম আশানুরূপ কমে না।
এছাড়া আমদানি শুল্কের কথা উল্লেখ করে কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন,
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, যেসব পণ্য আমদানি করা হয় তার শুল্ক এত বেশি থাকে যে দেশের বাজারেও দাম বাড়তি পড়ে। এতে করে যে দেশে দাম কম সেখান থেকে পণ্য আমদানি করে পরে আবার দেশের বাজারে শুল্কের খরচ ওঠাতে বাড়তি দামে বিক্রি করতে হয়।
বিশ্ববাজার পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, মূলত করোনার সময়ের রেশ না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞা এবং সরবরাহ সংকটের কারণে গত বছর ফেব্রুয়ারি-মার্চের দিকে সামষ্টিকভাবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৩২ শতাংশে পৌঁছায়। পরবর্তীতে অবস্থা স্বাভাবিক হতে শুরু করলে হ্রাস পেতে থাকে মূল্যস্ফীতি।
গত মাসের বিশ্বব্যাংকের খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এশিয়ার ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, এবং মালদ্বীপের মতো দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি অনেকটাই কমে এসেছে। শুধু বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে এখনো খাদ্য মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাবার কোনো লক্ষণ নেই।
গত মাসে বিশ্ববাজারে শস্যপণ্যের দাম কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। সে তুলনায় বাংলাদেশে কেন পণ্যের দাম কমছে না জানতে চাইলে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রো ইকোনোমি বিভাগের চেয়ারম্যান রিপন কুমার মণ্ডল বলেন, মূলত বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম কমলে সঙ্গে সঙ্গে তা সমন্বয় করা সম্ভব। কিন্তু খাদ্যপণ্যের বেলায় সেটি সম্ভব হয় না।
খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার সঙ্গে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে রিপন বলেন, একজন কৃষকের থেকে পণ্য নিয়ে বাজারে আসতে যতগুলো চ্যানেল পার হওয়া লাগে তাতে করে দাম অনেক বেড়ে যায়। মধ্যস্বত্বভোগী থাকতেই পারে কিন্তু সেটি যদি প্রতিটি চ্যানেলে থাকে সেখানে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি কমানো কঠিন হয়ে পড়ে।
এর সমাধান হিসেবে নতুন কোনো নীতি গ্রহণ করা উচিত কিনা জানতে চাইলে রিপন বলেন,
এরজন্য নতুন নীতির প্রয়োজনের থেকে বেশি দরকার বিদ্যমান নীতিমালার প্রয়োগ। বাংলাদেশের কাচাবাজারে পণ্যের গ্রেডিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। এছাড়া পণ্য পরিবহন ব্যবস্থাও এমন, যেখানে অপচয় হয় বেশি। এ অবস্থায় মান অনুযায়ী পণ্য গ্রেডিং করে বিক্রি করলে দামে সামঞ্জস্য আসবে বলে জানান তিনি।
খাদ্য মূল্যস্ফীতির বাইরে মূল মূল্যস্ফীতি নিয়ে জুন মাসে সময় সংবাদকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, দেশ যখন রাজস্ব আদায়ের জন্য পরোক্ষ করের ওপরে বেশি নির্ভরশীল, তখন এটি আয় বৈষম্য সৃষ্টি করে। রাষ্ট্র যখন আমদানি শুল্ক কিংবা মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) থেকে রাজস্ব আয় অর্জনকে মুখ্য মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করে, তখন এমনিতেই বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। আর পণ্যের দাম বেড়ে গেলে কিংবা দেদারছে পণ্যের ওপর ভ্যাট আরোপ করলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ে সমাজের স্বল্পআয়ের মানুষেরা।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের শুরুর প্রথম চার মাসেই বোঝা যাচ্ছিলো যতটা শঙ্কা করা হয়েছে ২০২৩ সাল নিয়ে, তার সিকিভাগও সত্যি হচ্ছে না। দুর্ভিক্ষের ভয় থাকলেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। খাদ্যপণ্যের দামের পাশাপাশি কমেছে জ্বালানির দাম। বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি কমতে যতটা সময় লাগবে বলে ধারণা করা হয়েছিল, তার থেকেও কম সময়ে মূল্যস্ফীতি স্বাভাবিক রূপ ধারণ করতে শুরু করেছে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক আউটলুকের তথ্য থেকে জানা যায়, গত বছর বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৮.৭ শতাংশ, যা চলতি বছর কমে ৬.৮ শতাংশে দাঁড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া ২০২৪ সালে এ মূল্যস্ফীতি আরও কমে হবে ৫.২ শতাংশ।
এদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ। তবে চলমান ঊচ্চমূল্যস্ফীতি ও বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় আদৌ সাড়ে ছয় শতাংশের মধ্যে মূল্যস্ফীতিকে ধরে রাখা সম্ভব কি না, এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে চেষ্টা অব্যাহত থাকলে সেটি সম্ভব বলে মত তাদের।
এ ব্যাপারে ভারতের উদাহরণ টেনে এম এম আকাশ বলেন, যদি কৃষকদের আলাদা একটি সংঘ তৈরি করা সম্ভব হয়, যেটা ‘সেলফ হেল্প সার্ভিস’ নামে ভারতে প্রচলিত আছে, তাহলে কৃষক সরাসরি নিজেদের পণ্য ক্রেতার কাছে পৌঁছাতে পারবে। এতে একদিকে কৃষক দামে পাবে, অন্যদিকে ক্রেতা কম দামে পণ্য কিনতে পারবে। এতে করে সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি নাগালের মধ্যে চলে আসবে।