আফগানিস্তানের নারীদের দুরবস্থার করুণ কাহিনি কে না জানে। বিশ্বজুড়ে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে তালেবানের আফগান নারীদের অধিকার হরণের কথা। নারীদের জন্য সেখানে বন্ধ হয়ে গেছে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দুয়ার। কয়েক দিন আগে তালেবান ফতোয়া দিয়েছে- মেয়েরা শুধু পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করতে পারবে। এখন চাকরিও হারাচ্ছেন নারীরা। নিজ দেশে নারীদের যখন এ অবস্থা, ঠিক তখন বাংলাদেশে একটু একটু করে নিজের লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন আফগান লড়াকু তরুণী ওয়াহিদা ইমান। ২২ বছর বয়সী আফগান এই তরুণী অন্য রকম এক ‘যুদ্ধ’ জয় করে এখন এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের একজন সফল শিক্ষার্থী। তবে তাঁর বাংলাদেশে অধ্যয়ন করতে আসার গল্পটি খুব সহজ নয়। জনস্বাস্থ্য বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত ওয়াহিদা সমকালের কাছে তুলে ধরেছেন জীবনজয়ী সেই গল্প।
আফগানিস্তানের লাঘমান প্রদেশে বসবাস ওয়াহিদার পরিবারের। পিতা-মাতার আট সন্তানের মধ্যে পঞ্চম তিনি। বাবা পেশায় টেইলার্স মালিক, মা চিকিৎসক। তাঁর পরিবারের সবারই বেশ আগ্রহ শিক্ষাদীক্ষায়। বিশেষ করে বড় ভাই আহমেদ আরভিন ও সনিকা আরিয়ানের সহায়তায় সেখানে শিক্ষা অর্জন করেছেন ওয়াহিদা। তবে সব মিলিয়ে তাঁর ছেলেবেলা তেমন একটা সুখকর ছিল না। কথা প্রসঙ্গে ওয়াহিদা জানান, একদিকে নিজ পরিবারে বৈষম্য, অন্যদিকে ছোটবেলায় মসজিদে শিক্ষা নিতে গিয়ে প্রতিদিন মার খাওয়া। প্রায় চার বছর এভাবেই তাঁর কেটেছে। এক পর্যায়ে বড় বোনকে জানালে পরিবারের সদস্যরা তাঁকে মাদ্রাসা থেকে ছাড়িয়ে এনে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। কিন্তু দশম শ্রেণিতে স্কুলেও নারী প্রিন্সিপাল তাঁকে নানা অজুহাতে শাস্তি দিতেন। বিষয়টি এমন- তাঁর যেন কপালটাই খারাপ। আর কপাল কেনই বা খারাপ হবে না, তাঁর জন্ম যে আফগানিস্তানে!
তবে নিজের স্বপ্ন পূরণে অটল ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন তিনি। তাই শত প্রতিকূলতার মধ্যেও শিক্ষা অর্জন থেকে কখনও সরে আসেননি। স্বাস্থ্য, নারীশিক্ষা ও পরিবেশ-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে সব সময় কাজ করতেন। তালেবান আফগানিস্তান দখলের আগে বোনের সঙ্গে মিলে বিভিন্ন সেমিনার ও কর্মশালায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। এমনকি তালেবান আফগানিস্তান দখলের এক দিন আগেও এক সেমিনারে ব্যস্ত ছিলেন ওয়াহিদা। সেমিনারের সেই ছবি দেখিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, কখনও ভাবতেই পারেননি, পরদিন থেকেই পাখির মতো ওড়ার স্বপ্ন থমকে যাবে। ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট আফগানিস্তান দখল করে নেয় তালেবান। ‘জীবন এরপর থেকে খারাপ থেকে আরও বেশি খারাপ হতে থাকে’- বলেন তিনি।
বাংলাদেশে আসার গল্প
তালেবানি শাসনে মানুষ যখন অতিষ্ঠ, তখনও নিজের ইচ্ছায় অটল ছিলেন ওয়াহিদা। স্বপ্নের কথা জানান বড় বোন সনিকাকে। বড় বোনের বান্ধবী প্রথম তাঁকে বাংলাদেশের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের কথা জানান। দুই বোনই আবেদন করেন পূর্ণাঙ্গ স্কলারশিপে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য। তবে ভাগ্যক্রমে শুধু ওয়াহিদা সুযোগ পেয়ে যান।
স্কলারশিপ পাওয়া যতটা সহজ ছিল, এর চেয়ে বহু গুণ কঠিন ছিল ওয়াহিদার বাংলাদেশে আসা। অন্য দেশে পড়তে যাবেন- এটি বাবা কিংবা মা কেউ-ই জানতেন না। কারণ তাঁরা জানলে খুশি হয়ে জানাবেন আত্মীয়দের। যার পরিণামে নেমে আসতে পারে মৃত্যুর খÿ। তাঁর শহরের তিন মেয়ে অন্য দেশে পড়ার স্কলারশিপ পেয়েছিলেন। তালেবান এ খবর জেনে যাওয়ায় দেশ ছাড়ার আগেই গুম হয়ে যান তাঁরা। কিছুদিন পর পাওয়া যায় তাঁদের লাশ।
এখানে আসার গল্পটা শুরু করতেই কালো মেঘে ঢেকে যায় তাঁর মুখ। এক দফা এয়ারপোর্টে তালেবান সৈন্যদের কাছে আটকা পড়েন তিনি। প্রথমবার বাংলাদেশে আসার সময় তাঁর সঙ্গে নিজের পরিবারের কোনো পুরুষ সদস্য ছিল না। এদিকে কোনো পুরুষ সদস্য না থাকলে বিমানে উঠতে দেবে না তালেবান। বিমানবন্দরে পাশে থাকা এক পরিবারকে সদস্য বানিয়ে বিমানে ওঠার চেষ্টা করেন তিনি। ওই পরিবারের পুরুষকে তাঁর আপন চাচা বলে পরিচয় দেন। কিন্তু তালেবান সৈন্যরা সবকিছু পরীক্ষা করে ধরে ফেলে- ওই লোক তাঁর আপন চাচা নয়। তারা আটক করে ফেলে ওয়াহিদাকে। পাসপোর্ট আটক করে ‘লাল মার্ক’ দিয়ে দিতে চায়। এই লাল দাগ পাসপোর্টে পড়ে গেলে আর কখনও দেশের বাইরে যাওয়া যাবে না। ঠিক তখনই বাংলাদেশের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের এক মেন্টরকে ফোন দেন তিনি। তাঁরই নির্দেশনায় ওয়াহিদা পাসপোর্ট নিয়ে তালেবান সদস্যদের বলেন, তিনি বাসায় চলে যাবেন, আর এয়ারপোর্টে আসবেন না। এভাবে ছাড়া পান তিনি।
পরে গত বছরের ২২ অক্টোবর ভাইয়ের সঙ্গে বাংলাদেশে আসেন ওয়াহিদা। তবে আসার আগের দিন বাবা-মায়ের কাছে বিদায় নিতে গেলে তাঁরা কল্পনাও করেননি, না জানিয়ে বাংলাদেশে আসার ব্যবস্থা করেছে তাঁদের আদরের মেয়ে। তাঁর কথায়, ‘যেন মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি বাংলাদেশে।’
স্বপ্ন বুনছেন নতুন দিনের
‘আমি খুবই ভাগ্যবান, আমি বাংলাদেশে আসতে পেরেছি। এই দেশটি বেশ সুন্দর। মানুষও খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি আমি আফগানিস্তানের চেয়ে এখানে বেশ ভালো আছি’- বলেন তিনি। ‘জনস্বাস্থ্য’ বিষয়ে স্নাতকে চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে তাঁর পাঁচ বছরের শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছে। বর্তমানে ভাষাসহ মৌলিক শিক্ষা অর্জন করছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়েই। স্নাতক শেষে মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর অর্জন করতে চান এই স্বপ্নবাজ তরুণী।
বাংলাদেশের খাবার, মানুষের আতিথেয়তা ও বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ মুগ্ধ করেছে তাঁকে। ধীরে ধীরে আয়ত্ত করছেন বাংলা ভাষা। বাংলাদেশি নারীরা এখানে নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করছেন- বিষয়টি অনুপ্রেরণা জোগায় তাঁকে। তবে ওয়াহিদার লক্ষ্য নিজের দেশকে নিয়ে। শিক্ষা কার্যক্রম শেষে দেশে ফিরে আফগানিস্তানের নারীদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়তে চান তিনি। ওয়াহিদা মনে করেন, একদিন তালেবানি শাসনের অবসান হবে। তাঁর স্বপ্নও পূরণ হবে। খবর সমকালের